বর্ষাকালের এই স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ায় বাড়তি ঝক্কি হিসেবে আমাদের বাড়িতে যে পোকাগুলোর উপদ্রব সবচাইতে বেশি হয়, তার মধ্যে উইপোকা অন্যতম। আমাদের দরকারি বিভিন্ন কাগজপত্র, বই-খাতা, জামাকাপড়, টাকাপয়সা কিংবা কাঠের কোনো জিনিসে যদি একবার উইপোকা আক্রমণ করে বসে, তাহলে তা থেকে সহজে মুক্তি পাওয়া খুবই কঠিন। আর আপনার বাড়ির পরিবেশ যদি স্বাভাবিকের চাইতে একটু স্যাঁতস্যাঁতে হয়, তাহলে তো কথাই নেই! তখন উইপোকার উপদ্রবে বাড়িতে কোনো জিনিস রাখাই সবার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে।
কি, আরো জানতে চান? আজকের লেখায় আমরা জানবো উইপোকা কেন হয়, এর জীবন চক্র ও উইপোকার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বিস্তারিত।
বাড়িতে উইপোকা কেন হয়?
উইপোকাকে ইংরেজিতে বলা হয় Termite. এই পোকাটি দেখতে হালকা হলুদ বা ফ্যাকাশে রঙের। উইপোকা নরম দেহবিশিষ্ট আইসোপ্টেরা বর্গের এক দল সামাজিক স্বভাবের পোকা। উইপোকা প্রধানত গরম বা গ্রীষ্মমন্ডলীয় আবহাওয়া বিরাজ করে এমন দেশসমূহে বাস করে। এই পোকা সাধারণত মৃত উদ্ভিদের দেহের অংশবিশেষ, কাঠ, পাতার মধ্যে উপস্থিত থাকা বর্জ্য, মাটি, প্রাণী বর্জ্য ইত্যাদি খেয়ে জীবন ধারণ করে।
প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই যেন এক বড় সমস্যার নাম উইপোকা। এটি বইয়ের তাক, ঘরের আসবাবপত্র, সিঁড়ির তলা বা ঘরের দেয়ালে ছড়িয়ে থাকে । আপনার বাড়ির পরিবেশ যদি স্যাঁতস্যাঁতে হয় বা রোদ-বাতাস কম থাকে, তবে উইপোকা হবার সম্ভাবনা সবচাইতে বেশি থাকে। তার পাশাপাশি বাড়ির আশেপাশে যেসব জায়গাতে আলো কম পৌছায় এবং যেসব স্থান নর্দমা বা নালার কাছাকাছি, উইপোকা সেখানেও বাসা বানিয়ে ফেলে।
যাদের ঘরে কাঠের আসবাবপত্র এবং নিজেদের প্রিয় বই আছে, তাদের সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা কাজ করে উইপোকা নিয়ে। কারণ ক্ষুদ্র এই পোকা অল্প সময়ের মাঝেই এগুলোর রীতিমতো বারোটা বাজিয়ে দিতে পারে। মাঝেমধ্যে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা গুদামে এই উইপোকা বেশ ক্ষতি করে থাকে।
উইপোকা বিভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করে এটির আবাসস্থল তৈরি করে। এই পোকাটি যেমন আর্দ্র ধরণের মাটির নিচে বাসা তৈরি করে, আবার একইসাথে কিন্তু শুকনো মাটির উপরের অংশেও এটি আবাসস্থল বা কলোনী তৈরি করে। উইপোকার বাসা অনেক সময় মাটির ওপরে উঠে আসে এবং তখন উঁচু ধরণের আকৃতি দৃশ্যমান হয়। উইপোকার এ ধরনের আবাস উইয়ের ঢিবি নামেই বেশি পরিচিত। এটিকে ইংরেজি ভাষায় বলা হয় termitaria.
উইপোকার জীবন চক্র
উইপোকারা একসাথে দলবদ্ধ হয়ে একটি কলোনীর মতো বসবাস করে। প্রতিটি কলোনী বানাতে সময় লাগে বছর পাঁচেকের মতো৷ এই পোকার একেকটি কলোনীতে মূলত তিন ধরণের উইপোকার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়, যেগুলো হলো:
- খাবার সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বসবাসের জায়গা সংরক্ষণের কাজে নিয়োজিত পোকা।
- যেকোনো ধরণের বিপদ বা আক্রমণ থেকে কলোনী নিরাপদ রাখার জন্য নিয়োজিত পোকা।
- বংশবিস্তারের জন্য পুরুষ ও স্ত্রী উইপোকা, যাদের কলোনীর রাজা রানী হিসেবে মনে করা হয়।
উইপোকার জীবনচক্রকে ইংরেজিতে ইনকমপ্লিট মেটামরফোসিস বলা হয়৷ সাধারণত উইপোকারা ডিম থেকে তাদের জীবনচক্র শুরু করে। স্ত্রী উইপোকা বা রানী পোকাই মূলত ডিম পাড়ে। একেকটি স্ত্রী উইপোকা প্রতিদিন ৩০০০০ এর মতো ডিম পাড়তে সক্ষম। উইপোকার ডিম ছোট ও সাদা রঙের হয়।
প্রতিটি ডিম থেকে একটি করে নিম্ফ বের হয়। নিম্ফ অবস্থায় এই পোকার একটি অ্যান্টেনা ও ছয়টি পা থাকে। নিম্ফ পর্যায়ে উইপোকা নিজেরা খাবার খেতে পারেনা।
তারপর কয়েকমাসের মধ্যেই একেকটি নিম্ফ প্রাপ্তবয়স্ক উইপোকাতে পরিণত হয়। পরিণত অবস্থায় গেলে একেকটি উইপোকা বিভিন্ন দায়িত্ব যেমনঃ খাবার সংগ্রহ, কলোনীর সুরক্ষা ইত্যাদি কাজে নিয়োজিত হয়।
উইপোকা কতদিন বাঁচে?
এ প্রশ্নের উত্তর দেয়া বেশ কঠিন। পরিবেশ পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে এই পোকা দুই থেকে পঞ্চাশ বছর বাঁচতে পারে।
উইপোকার বৈশিষ্ট্য
নিজেদের মধ্যে একতা থাকলেই সবকিছু সম্ভব। দলবদ্ধ হয়ে থাকলে যেকোনো কঠিন পরিস্থিতিও সামলানো যায়। উইপোকার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের জন্য গবেষকরা উইপোকাকে একটি সামাজিক পোকা বলেছেন। এখন আমরা জানবো এই পোকার কিছু বৈশিষ্ট্য সম্পর্কেঃ
- উইপোকা কাজ ভাগাভাগির নীতিতে বিশ্বাসী। এই পোকা কলোনীতে আগে নিজেদের মধ্যে কাজ ভাগ করে তারপর তা সম্পাদন করে।
- যেকোনো বিপদসংকুল পরিস্থিতিতে উইপোকা শান্তভাবে নিজেদের মধ্যে শৃঙ্খলা বজায় রেখে সে পরিস্থিতি মোকাবেলা করে। এখান থেকে বলা যায় বুদ্ধির ক্ষেত্রেও এই পোকা দারুণ উন্নত।
- কোথাও যাত্রা করার সময় একটি পোকা দল থেকে পিছিয়ে গেলে সেই পোকাটিকে সাথে না নেয়া পর্যন্ত গোটা দল অপেক্ষা করে।
- চলাচলের সময় উইপোকা তাদের দলনেতাকে সবার সামনে রেখে পেছনে বাকি পোকারা চলাচল করে।
- এই পোকা বিশেষ ধরণের সংকেত প্রেরণের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ বজায় রাখে।
এটুকুই ছিলো আজকের আলোচনা। আশা করি আজকের এই আর্টিকেল থেকে উইপোকা সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য জানতে পেরেছেন। সত্যি বলতে উইপোকাদের একতা থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার রয়েছে।